শফিক সাহেব এর মাথায় এখন দুনিয়ার চিন্তা। দু মাস ধরে বেতন হচ্ছে না। শফিক সাহেবের কোন রাজত্ব নেই যে তিনি তা দিয়ে তিনি সংসার চালাবেন। তারমত ইন্সপেক্টরের বেতন দিয়ে এ যুগে সংসার চালানো অসম্ভব। সামান্য বেতন দিয়ে ঢাকা শহরে তিন জনের সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। সংসারের খরচ, মেয়ের স্কুল ফিস, বাড়ি ভাড়া, অপরদিকে দ্রব্যমুল্যের লাগামহীন ছুটে চলা। কোনমতে টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়। বাড়তি আয়েশ কখনও করা হয়ে উঠে না। কলিগেরা আবার হাসাহাসি করেন তার সততা দেখে। পুলিশের চাকরিতে আবার সততা। তবুও দুবছর কোনরকমে চালিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু গত দুমাস ধরে বেতন হচ্ছে না। ডিপার্টমেন্টের কি এক ঝামেলা। খোজখবর করার কেউ নেই। সরকারি বেতন দিয়ে কি হবে? সবার উপরি আয় দিয়ে বেশ চলে যাচ্ছে। তার মত সৎ মানুষ কোথায়? ১ম মাসে বেতন হয় নি। ধার দেনা করে সংসার চালিয়ে নিয়েছেন। যার কছে ধার করতে গিয়েছিলেন সে শফিক সাহেব পুলিশ শুনে ঘাড় কাত করে হাসলেন। পুলিশের লোকের আবার কোন ধার করতে হয় নাকি? বলে কয়ে ধার এনেছেন শফিক সাহেব। ২য় মাসে ধার করতে যাওয়ার পর ধারদানকারি এমন ভাবে তাকালেন যেন শফিক সাহেব ভিনগ্রহ থেকে এসেছেন। সেবারও কোনমতে বলে কয়ে ধার নিয়ে এসেছেন। এবার কি হবে? এবারও যে বেতন হচ্ছে না তা প্রায় নিশ্চিত। শফিক সাহেব কোন কুল কিনারা খুজে পাচ্ছেন না। তার মত সৎ অফিসারের এ দুনিয়ায় কোন ভাও নেই। দুনিয়া এখন তার কাছে নরক হয়ে গেছে। নরকের আগুন এখন তার মুখের সামনে দাপাদাপি করছে। এক সময় কপ করে তাকে গিলে ফেলবে। মেয়ের স্কুলের বেতন দেওয়া হয় নি দুমাস ধরে। স্কুল থেকে নোটিশ আসছে। পরপর তিন মাস বেতন না দিতে পারলে স্কুল থেকে মেয়েকে বহিস্কার করা হবে। ঢাকার স্কুলে নিস্ব শিক্ষার্থীর কোন মুল্য নেই। নিস্ব শিক্ষার্থীরা বোঝা স্বরুপ। কেউ বোঝা রাখতে চায় না। সবাই চায় বোঝা ঝেড়ে ফেলতে। টুনটুনি ও ব্যাপারটা জেনে গেছে হয় তো। হয়তো স্কুলের টিচাররা জিজ্ঞেস করেছে কিছু। কাল গোমড়া মুখে শফিক সাহেব কে জিজ্ঞেস করছিল, বাবা, আমি কি আর স্কুলে যাব না?
শফিক সাহেব মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, কে বলেছে যাবে না? অবশ্যই যাবে মা।
বাবা, তুমি কি আমাকে একটা রেলগাড়ি কিনে দিবে? মিরার বাবা ওকে একটা রেলগাড়ি কিনে দিয়েছে।
তাই নাকি? তাহলে তো আমার মাকে ও একটা রেলগাড়ি কিনে দিতে হয়।
টুনটুনি জড়িয়ে ধরে বাবাকে। দৌড়ে গিয়ে মাকে জানায় রেলগাড়ির কথা। শাহীনা বেগম স্বামীর দিকে তাকান। সে দৃষ্টিতে খুশি নয়, কষ্টের আনাগোনা পরিষ্কার বোঝা যায়।
শফিক সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি উপরি আয় করবেন। পুলিশের চাকরি সৎভাবে করে সংসার চালানো যায় না। তার উপর দুমাস ধরে বেতন হচ্ছে না। ধার দেনাও অনেক হয়ে গেছে। জীবন বাচানো ফরয। জীবন বাচাতে কিছুটা উপরি আয় করা কোন পাপ না। আগে জীবন পরে নীতি। জীবন থাকলে নীতির ব্যাপার দেখা যাবে।
স্যার, রফিক নামের পোলার বাপ আসছে। আপনার সাথে কথা বলতে চায়। পাঠায়া দিব?, হাবিলদার এসে জানান দেয়।
ভিতরে পাঠিয়ে দাও।
হাবিলদার বের হয়ে যেতেই রফিকের বাবা ঢুকলেন। গরীব কেতা দুরস্ত মানুষ। পোশাক দেখলেই বোঝা যায় জীবন যুদ্ধের পরাজিত হতাশ সৈনিক।
স্যার আমার পোলাটারে ছাইড়া দেন, ও কিছু করে নাই।
কিছু করে নাই তুমি কি জান? বলে ধমকে উঠলেন শফিক সাহেব। তোমার ছেলে মাদক ব্যবসায়ী। ওর কাছ থেকে হেরোইন পাওয়া গেছে।
ও হেরোইন দিয়া কি করবে স্যার। ওতো কলেজ যাইতাছিল। পথে কনস্টেবল সাব ধইরা থানায় নিয়া আসল। বলে হের কাছে নাকি নেশার চিজ পাইছে।
সেটা দিয়া আমার কিছু না। সে হিরোইন সহ ধরা খেয়েছে, এখন জেল জরিমানা হবে।
স্যার আপ্নে কিছু একটা করেন।
আমি কি করব? মাদকের মামলা। কোন ছাড় নেই। আচ্ছা যাও, দশ হাজার টাকা যোগার করে নিয়ে আস, তারপর দেখি কি হয়!
দশ হাজার! আমি গরীব মানুষ স্যার। এতো টাকা কই পামু?, বলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রফিকের বাবা।
না পাইলে নাই, পোলার জেল হবে জরিমানা হবে। এসব তো হয়ই। জেল জরিমানাট লজ্জার কিছু না।
রফিকের বাবা মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নিচু করে বেড়িয়ে যায়। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে শফিক সাহেবের। বুকে একটা চিন চিনে ব্যাথা উকি দিয়ে যায়। এক ঘন্টা পড়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে রফিক কে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় তার বাবা। টাকাটা নেওয়ার সময় শফিক সাহেব আশে পাশে দেখে নিলেন। কেউ দেখে নি। হয়তোবা দেখেছে। শেষ বিচারের সময় সব বেড়িয়ে আসবে। দুই কাধের দুই ফেরেস্তা কেরামুন কাতিবিন সব হড়বড় করে বলে যাবে। একজন অপরাধ প্রমান করার চেস্টা করবে, অপরজন বাদীকে নির্দোষ প্রমানের মিছে চেষ্টা করে যাবে। এক সময় প্রমানিত হবে বাদী গুনাহগার। পাই পাই পয়সার জন্য শাস্তি হবে। যেমন তেমন শাস্তি নয়, জাহান্নামের কঠোর শাস্তি।
টাকাটা পকেটে রাখলেন শফিক সাহেব। ঘটনা ঘটল একটু পর। দুপুরে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে শফিক সাহেব দেখলেন হাতে কালি লেগে রয়েছে। ট্যাপ ছেড়ে কালি ধোয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কালি কিছুতেই যাচ্ছে না। যত ঘসছেন তত বাড়ছে। এক সময় হাল ছেড়ে রুমে চলে এলেন শফিক সাহেব। হাতের কালি এখনো যাচ্ছে না। রুমাল দিয়ে ঘসতে লাগলেন। এমন সময় আরেফিন সাহেব রুমে ঢুকলেন। কিছু জরুরি ফাইল পত্র দেখাতে। ফাইল পত্র দেখতে দেখতে রুমাল দিয়ে হাত ঘসতে লাগলেন শফিক সাহেব। আরেফিন সাহেব তা দেখে বললেন,
কিছু হয়েছে স্যার?
কই নাতো!
ওইযে হাত ঘসছেন তো স্যার, তাই বললাম।
ও। হাতে কালি লেগেছে। কিছুতেই যাচ্ছে না।
কই দেখি স্যার।
শফিক সাহেব হাত বাড়িয়ে কালি লেগে থাকা জায়গা দেখালেন।
কই স্যার! কালি নেই তো।
কি বলছো, এইতো কালি লেগে রয়েছে। এই যে এখানে।
কোন কালি নেই স্যার।
কি বলছ? দেখছ না? এই যে কালি। আরো বেড়েছে হয়তো।
আরেফিন সাহেব এমন ভাবে তাকালেন যেন শফিক সাহেব পাগল হয়ে গেছেন।
স্যারের শরীরটা কি খারাপ করেছে নাকি? বাসায় চলে যান স্যার।
না, শরীর ঠিকই আছে। দেখি ফাইল গুলো।
শফিক সাহেব ফাইল গুলো দ্রুত দেখে দিলেন। আরেফিন সাহেব চলে যাবার পর আবার হাতের দিকে তাকালেন। এখনও কালি লেগে আছে। আরেকটু ছড়িয়েছে। শফিক সাহেব রুমাল দিয়ে ঘষলেন। কালি গেল না। বরং আরেকটু বেড়ে গেল। হাবিলদার চা দেওয়ার সময় শফিক সাহেব বললেন, দেখোতো করিম, হাতে কালি আছে কিনা?
কই, না স্যার, কোন কালি নেই।
শফিক সাহেব বললেন, আচ্ছা যাও।
এরা কেউ কালি দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তিনি দেখতে পাচ্ছেন। কালি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে হাতে।
রাতে একটা খেলনা রেলগাড়ি আর বউয়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে বাসায় ফিরলেন শফিক সাহেব। রেলগাড়িটা টুনটুনিকে দিলেন। রেলগাড়ি পেয়ে টুনটুনি খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেল। সাথে সাথে প্যাকেট খুলে মাকে দেখাতে লাগল। শাহীনা বেগম অবাক হয়ে বললেন, বেতন হয়েছে নাকি?
হ্যা, বলে শফিক সাহেব শাড়িটা স্ত্রীর হাতে দিলেন। খুশি মনে শাড়িটা দেখতে লাগলেন শাহীনা বেগম। শফিক সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,
শাহীনা, দেখতো আমার হাতে কোন কালি আছে কিনা?
কই, নাতো। কেন?
না এমনি।
শফিক সাহেব এখনো কালি দেখতে পারছেন। কালি আরো ছড়িয়ে গেছে। এখন হাতের অনেকটা জুড়েই কালি রয়েছে। রাতে খাবার পড় শফিক সাহেব বেসিনে গিয়ে হাত ধোয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কালি এখনো যাচ্ছে না। আরো বেড়েই চলেছে। এমন সময় পিছন থেকে শাহীনা বেগম বলে উঠলো,
কি হয়েছে?
কই, কিছু হয় নিতো। বলে আমতা আমতা করতে লাগলেন শফিক সাহেব।
শাহীনা বেগম চোখ সরু করে বললেন, তাহলে সাবান দিয়ে হাত ঘসেই যাচ্ছো কেন?
শফিক সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, শাহীনা, আমার হাতে না কালি লেগে রয়েছে। কিছুতেই যাচ্ছে না। খালি বেড়েই চলেছে।
কই কোথায়?
কালিতো আমি ছাড়া কেউ দেখতে পায় না। খালি আমিই দেখি। সারা হাত ভরা কালি। এই দেখ, বলে হাতটা সামনে মেলে ধরলেন শফিক সাহেব। শাহীনা বেগম সেখানে কোন কালি দেখতে পেলেন না। তার স্বামীর কথা তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। শফিক সাহেব সাবান দিয়ে হাত ঘসতে লাগলেন। কালি মুছতে হবে। কালি বেড়ে যাচ্ছে। রেলগাড়ি হাতে টুনটুনি বাথরুমের দরজায় মায়ের পাশে এসে দাড়াল। ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। শফিক সাহেব এখনো হাত ঘষেই যাচ্ছেন।
বাবা তোমার কি হয়েছে?
কিছু হই নি তো মা, বলে শফিক সাহেব আরো জোড়ে হাত ঘসতে লাগলেন।
মা মেয়ে দুইজন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শফিক সাহেব এখনো হাত ঘষেই যাচ্ছেন। কালি যাচ্ছে না। কালি আরো ছড়িয়ে পড়ছে। কালো বিশ্রী কালি।
০১ ডিসেম্বর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪